বন্ধুরা, কেমন আছো সবাই? আজকালকার তরুণ-তরুণীরা যে কত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, তা কি আমরা সবাই খেয়াল করেছি? পড়াশোনার চাপ, সামাজিক মাধ্যমের দুনিয়া আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা – সব মিলিয়ে ওদের মনোজগতে এক অন্যরকম আলোড়ন চলছে। অনেক সময় মনে হয়, ওদের সমস্যাগুলো বুঝতে পারা বা সমাধান বের করা যেন হিমশিম খাওয়ার মতোই কঠিন। বিশেষ করে বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে, মাদকের সহজলভ্যতা এবং পারিবারিক বন্ধনের অভাবও এর বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু চিন্তা নেই!

আমাদের চারপাশে এমন দারুণ কিছু মানুষ আছেন, যারা কিশোর পরামর্শদাতা হিসেবে এই তরুণদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। এই পরিবর্তনশীল বিশ্বে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ অনেক সময় হতাশা, একাকিত্ব বা পারিবারিক সমস্যার কারণে কিশোররা চরম পদক্ষেপ নিতেও বাধ্য হয়। আর যদি আমরা এমন কিছু যুগোপযোগী ধারণা আর সহজ উপায় খুঁজে বের করতে পারি, যা ওদের পথচলায় সত্যিই কাজে দেবে, তাহলে কেমন হয়?
চলো, তাহলে আমরা আজ এমনই কিছু দারুণ আইডিয়া আর ব্যবহারিক টিপস সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই!
তরুণ মনের অজানা দুনিয়া: ওদের কথা শোনাটা কেন জরুরি?
কিশোর বয়সের মানসিক টানাপোড়েন বোঝা
বন্ধুরা, কেমন আছো সবাই? তোমরা কি কখনও ভেবে দেখেছো, আমাদের চারপাশের এই ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা, মানে এই কিশোর-কিশোরীরা ঠিক কতটা মানসিক চাপ আর অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে?
পড়াশোনার চাপ তো আছেই, তার সাথে সামাজিক মাধ্যমের দুনিয়া, বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে চলা, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা – সব মিলিয়ে ওদের মনোজগতে এক অন্যরকম আলোড়ন চলছে। অনেক সময় আমরা বড়রা ওদের সমস্যাগুলোকে হয়তো ততটা গুরুত্ব দিই না, ভাবি “ছোট মানুষ, কী আর এমন সমস্যা!” কিন্তু বিশ্বাস করো, ওদের ভেতরের ঝড়টা অনেক সময় আমাদের ধারণারও বাইরে থাকে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে, এই বয়সে মনের মধ্যে কত শত প্রশ্ন আর দ্বিধা কাজ করে, যা হয়তো সহজে কারো কাছে বলাও যায় না। আর এই না বলতে পারার যন্ত্রণা থেকেই জন্ম নেয় একাকীত্ব, হতাশা, এমনকি কখনও কখনও ভুল পথে পা বাড়ানোর প্রবণতাও। তাই ওদেরকে বোঝাটা, ওদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনাটা এখন আর কেবল একটা চাওয়া নয়, এটা এখন সময়ের দাবি। ওরা যখন কথা বলতে চায়, তখন শুধু শুনে যাও, কোনো উপদেশ ছাড়াই। দেখবে, এইটুকুতেই ওরা কতটা স্বস্তি পায়।
অভিভাবকদের সাথে খোলামেলা আলোচনার গুরুত্ব
অনেক বাবা-মায়ের সাথে যখন আমি কথা বলি, তারা বলেন, “আমার ছেলে/মেয়ে তো কথাই বলতে চায় না।” আবার সন্তানদের দিক থেকে শুনি, “বাবা-মা আমাকে বোঝেন না।” এই যে একটা অদৃশ্য দেয়াল, এটা ভাঙাটা ভীষণ জরুরি। আমি নিজেও যখন ছোট ছিলাম, তখন অনেক কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারতাম না, কারণ একটা অজানা ভয় কাজ করত। ভাবতাম, হয়তো বকা শুনব বা আমাকে ভুল বুঝবে। তাই এখন যখন আমি তরুণদের নিয়ে কাজ করি, তখন সবার আগে এই সেতুটা তৈরির চেষ্টা করি। বাবা-মায়েদের বলি, সন্তানের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ুন। দিনের শেষে একসাথে বসে একটু গল্প করুন, শুধু পড়াশোনা নিয়ে নয়, বরং ওদের দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। জিজ্ঞাসা করুন, “আজ তোমার দিনটা কেমন গেল?
কোনো মজার ঘটনা ঘটেছে কি?” এই ছোট ছোট কথোপকথনগুলো ওদের মনে সাহস যোগায়, আস্থা তৈরি হয়। আর আস্থা তৈরি হলে ওরা নিজেদের সমস্যাগুলোও শেয়ার করতে দ্বিধা করবে না। মনে রেখো, খোলামেলা আলোচনা যে কোনো সম্পর্কের ভিত্তি।
আমার অভিজ্ঞতা: ওদের কথা শুনলে কী ম্যাজিক ঘটে?
আমি যখন প্রথম কিশোর পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ শুরু করি, তখন আমার মনেও অনেক সংশয় ছিল। ভাবতাম, আমি কি সত্যিই ওদের সাহায্য করতে পারব? কিন্তু ধীরে ধীরে যখন আমি ওদের সাথে মিশতে শুরু করলাম, ওদের কথা শুনতে শুরু করলাম, তখন বুঝলাম যে, শুধু শুনে যাওয়াটা কতটা শক্তিশালী একটা কাজ। আমার মনে আছে, একবার একজন কিশোরী তার পরীক্ষার চাপ আর বন্ধুদের সাথে ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে ভীষণ হতাশ ছিল। সে কারো সাথে কথা বলতে পারছিল না। আমি শুধু ওকে চুপ করে বসে ওর কথাগুলো শুনতে দিয়েছিলাম। সে অনর্গল কথা বলে গেল প্রায় এক ঘণ্টা ধরে। কোনো সমাধান দেইনি, শুধু শুনেছিলাম আর মাঝে মাঝে “হুম” বা “বুঝতে পারছি” বলে ওর পাশে ছিলাম। সেশন শেষে সে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিল, “এত হালকা লাগছে, মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে একটা বিশাল পাথর নেমে গেল!” এই ঘটনাই আমাকে শিখিয়েছে, অনেক সময় আমরা সমাধান চাই না, শুধু এমন একজন মানুষ চাই যে আমাদের কথাগুলো শুনবে, কোনো বিচার ছাড়াই। এটাই ম্যাজিক, বন্ধুরা।
মানসিক চাপ থেকে মুক্তির পথ: কী করা যায় পরিবার ও সমাজের পক্ষ থেকে?
মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় পরিবারের ভূমিকা
আজকাল মানসিক স্বাস্থ্য শব্দটা আমরা অনেক বেশি শুনি, কিন্তু এর গুরুত্বটা কি আমরা সত্যিই বুঝি? আমাদের তরুণ প্রজন্ম যে শুধু শারীরিক সুস্থতা নিয়ে চিন্তিত নয়, বরং মানসিক সুস্থতাও তাদের জন্য অপরিহার্য, এটা পরিবারগুলোকে সবার আগে বুঝতে হবে। আমি দেখেছি, অনেক পরিবারেই যখন একটা বাচ্চা মনমরা থাকে বা হঠাৎ রেগে যায়, তখন সেটাকে “অবাধ্য” বা “বদমেজাজি” বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ এটা হতে পারে কোনো গভীর মানসিক চাপের লক্ষণ। পরিবার যদি শুরু থেকেই এই বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে দেখে, তাহলে অনেক বড় সমস্যা এড়ানো সম্ভব। বাড়িতে একটা ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে সবাই সবার অনুভূতিগুলোকে সম্মান করে, হাসিমুখে কথা বলে, সেটাই কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার প্রথম ধাপ। আমার মতে, সন্তানের সাথে রাগারাগি না করে, তাকে বোঝার চেষ্টা করুন। যদি দেখেন সে বারবার একই সমস্যায় পড়ছে, তাহলে একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না। মনে রাখবেন, মানসিক সুস্থতাও শারীরিক সুস্থতার মতোই জরুরি।
স্কুল ও সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি
শুধুই পরিবার নয়, স্কুল এবং সমাজকেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আরও অনেক বেশি কাজ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, স্কুলগুলো যদি পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নজর দেয়, তাহলে অনেক কিশোর-কিশোরী নিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে সংকোচ না করে শিক্ষকদের সাথে কথা বলতে পারবে। বিভিন্ন কর্মশালা, আলোচনা সভার আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা এসে তরুণদের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করবেন। সমাজে এখনো মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক ভুল ধারণা আছে, অনেকে এটাকে পাগলামি মনে করে। এই স্টিগমা বা কলঙ্ক দূর করতে হবে। আমি সম্প্রতি একটি স্কুলে গিয়েছিলাম, সেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের সাথে এতটাই খোলামেলা ছিল যে, নিজেরাও অবাক হয়েছিলাম। শিক্ষকেরা শুধু পড়াচ্ছেন না, তারা যেন শিক্ষার্থীদের বন্ধু এবং পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করছেন। এই ধরনের উদ্যোগগুলো প্রতিটি স্কুল ও কলেজে নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
ছোট ছোট পদক্ষেপ, বড় স্বস্তি
মানসিক চাপ কমানোর জন্য কিছু ছোট ছোট অভ্যাসও খুব কাজে দেয়। যেমন – প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, পছন্দের গান শোনা, ছবি আঁকা বা কোনো সৃজনশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, খেলাধুলা করাও মনকে সতেজ রাখে। আমি নিজে যখন অনেক চাপের মধ্যে থাকি, তখন একটু বাইরে হেঁটে আসি বা আমার পছন্দের কোনো বই পড়ি। বিশ্বাস করো, এটা ম্যাজিকের মতো কাজ করে। তরুণদেরও এই ছোট ছোট বিষয়গুলোতে উৎসাহিত করতে হবে। আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যখন কোনো কিছু খুব বেশি চাপ মনে হবে, তখন একজন বিশ্বস্ত মানুষের সাথে কথা বলা। হতে পারে সে আপনার বন্ধু, ভাই-বোন, বাবা-মা অথবা একজন পরামর্শদাতা। কথা বললে মন হালকা হয়, আর সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়াও সহজ হয়।
ডিজিটাল আসক্তি: বন্ধু নাকি শত্রু? স্মার্ট ব্যবহারের সহজ সমাধান
স্ক্রিন টাইম কমানোর বাস্তবসম্মত কৌশল
বন্ধুরা, এখন তো আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট। এক মুহূর্তও যেন এগুলো ছাড়া চলে না। কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, এই ডিজিটাল দুনিয়াটা আমাদের জন্য বন্ধু নাকি শত্রু হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে স্ক্রিন টাইমের আসক্তিটা আমাকে ভীষণ ভাবায়। আমি অনেক দেখেছি, বাচ্চারা খাওয়া-ঘুম ভুলে সারাদিন ফোন বা ল্যাপটপে ডুবে থাকে। এটা শুধু চোখের সমস্যা তৈরি করে না, বরং মানসিক বিকাশেও বাধা দেয়। আমার নিজের এক ভাগ্নি এমন আসক্ত ছিল যে ওর মা-বাবা রীতিমতো চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। এরপর আমরা কিছু কৌশল নিয়ে কাজ করেছি, যেমন – রাতে ঘুমানোর এক ঘণ্টা আগে সব ধরনের স্ক্রিন বন্ধ করা, খাবার টেবিলে ফোন নিষিদ্ধ করা, এবং দিনে নির্দিষ্ট কিছু সময় (যেমন ২-৩ ঘণ্টা) স্ক্রিন ব্যবহারের জন্য বেঁধে দেওয়া। শুনতে সহজ মনে হলেও, এই অভ্যাসগুলো গড়ে তোলা বেশ কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। ছোট ছোট পদক্ষেপ নিয়ে শুরু করলে, ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনা সম্ভব।
অনলাইন সুরক্ষায় অভিভাবকদের করণীয়
ডিজিটাল আসক্তি কমানোর পাশাপাশি অনলাইন সুরক্ষাটাও ভীষণ জরুরি। ইন্টারনেটে ভালো জিনিসের পাশাপাশি খারাপ জিনিসও যে কতটা সহজে হাতের কাছে চলে আসে, তা আমরা সবাই জানি। কিশোর-কিশোরীরা না বুঝেই অনেক সময় ভুল পথে পা বাড়িয়ে ফেলে বা সাইবার বুলিং-এর শিকার হয়। অভিভাবকদের এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তানকে চোখ রাঙিয়ে বা জোর করে ফোন কেড়ে নিয়ে সমাধান হবে না। বরং তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে বোঝাতে হবে যে, অনলাইনে কোন কাজগুলো করা ঠিক আর কোনগুলো করা উচিত নয়। আমি অনেক বাবা-মাকে পরামর্শ দিয়েছি যে, সন্তানের সাথে বসে কিছু অনলাইন নিয়ম তৈরি করুন। যেমন, ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার না করা, অপরিচিতদের সাথে ভিডিও কলে কথা না বলা ইত্যাদি। বিভিন্ন Parental Control Apps ব্যবহার করেও স্ক্রিন টাইম ম্যানেজ করা যায়, তবে সচেতনতাই আসল সুরক্ষা।
ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বাস্তব জীবনে ফেরা
আসক্তি থেকে মুক্তির সেরা উপায় হলো বিকল্প কিছু খুঁজে বের করা। ভার্চুয়াল জগৎ থেকে ওদেরকে বাস্তব জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। ওদেরকে খেলাধুলায় উৎসাহিত করুন, বই পড়তে দিন, বন্ধুদের সাথে বাইরে খেলতে পাঠান, নতুন কোনো শখ তৈরি করতে সাহায্য করুন। যেমন, বাগান করা, ছবি আঁকা, গান শেখা, বা কোনো সামাজিক কাজে অংশ নেওয়া। আমার এক বন্ধু তার ছেলেকে ডিজিটাল আসক্তি থেকে বের করার জন্য একসাথে বিকেলে পার্কে হাঁটতে যেত আর বিভিন্ন খেলা খেলত। এখন তার ছেলে নিজেই বিকেল হলেই বলে, “চলো বাবা, বাইরে থেকে ঘুরে আসি।” এই পরিবর্তনটা আনতে একটু ধৈর্য আর সময় লাগে, কিন্তু ফলটা মিষ্টি হয়। মনে রাখবেন, ভার্চুয়াল জগৎ শুধু সময় নষ্ট করে না, বরং বাস্তব জীবনের আনন্দগুলোও কেড়ে নেয়।
কিশোর অপরাধ কেন বাড়ে? প্রতিরোধের সেরা কৌশল
মাদকের সহজলভ্যতা ও তার প্রতিকার
বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটা বড় উদ্বেগের বিষয়। বিশেষ করে মাদকের সহজলভ্যতা এর অন্যতম প্রধান কারণ। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি, কিভাবে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা খুব সহজে মাদকের জালে জড়িয়ে পড়ছে। একবার যদি কেউ এই চোরাবালিতে পা বাড়ায়, তখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসাটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আমার মনে আছে, আমার এক পরিচিত পরিবারের ছেলে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাদকাসক্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই পরিবারটির উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে, তা আমি কাছ থেকে দেখেছি। সমাজের প্রতিটি স্তরে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থাই নয়, পরিবার, স্কুল এবং সমাজের প্রতিটি মানুষকে এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে। তরুণদের কাছে মাদকের কুফল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরতে হবে এবং তাদেরকে বোঝাতে হবে যে, মাদক শুধু শরীরকে নয়, জীবনকেও শেষ করে দেয়।
পারিবারিক বন্ধনের অভাব: একটি বড় কারণ
মাদকের পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধনের অভাবও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। যখন একটা শিশু পরিবারে পর্যাপ্ত সময় বা ভালোবাসা পায় না, তখন সে বাইরের জগতে আশ্রয় খোঁজে। অনেক সময় ভুল বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে তারা খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে। আজকাল বাবা-মা দুজনেই কর্মজীবী হওয়ায় অনেক সময় সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, পরিবারে ভালোবাসা বা বন্ধন থাকবে না। অল্প সময় পেলেও সেই সময়টাকে কিভাবে ফলপ্রসূ করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। একসাথে খাবার খাওয়া, গল্প করা, ছুটির দিনে কোথাও ঘুরতে যাওয়া – এই ছোট ছোট বিষয়গুলো পরিবারের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তোলে। আমার মনে আছে, একবার একটি কেস স্টাডিতে দেখেছিলাম, যে কিশোরটি অপরাধে জড়িয়েছিল, তার পরিবারে পারস্পরিক যোগাযোগ প্রায় ছিলই না। তাই পরিবারে ভালোবাসার বন্ধনটা শক্ত করাটা ভীষণ জরুরি।
সামাজিক কর্মসূচী ও কাউন্সিলিং-এর প্রভাব
কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে সামাজিক কর্মসূচী এবং কাউন্সিলিং-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিভিন্ন ক্লাব, সংগঠন এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তরুণদের জন্য খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এবং দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের আয়োজন করে, তাহলে তারা সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে। বিশেষ করে যারা পিছিয়ে পড়া এলাকায় থাকে, তাদের জন্য এই ধরনের উদ্যোগগুলো আরও বেশি জরুরি। আমি দেখেছি, যখন কোনো কিশোরকে সঠিক পথপ্রদর্শক দেখানো হয়, তখন সে দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়। এছাড়া, যারা ইতিমধ্যেই অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, তাদের জন্য সঠিক কাউন্সিলিং এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করাটা জরুরি। শুধু শাস্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না, বরং তাদের মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধান করতে হবে।
স্বপ্ন পূরণের সারথি: একজন ভালো পরামর্শদাতার ভূমিকা
কাউন্সেলিং কেন জরুরি? ভুল ধারণা ভাঙা
আমাদের সমাজে কাউন্সিলিং বা পরামর্শ গ্রহণ করা নিয়ে এখনো অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। অনেকেই মনে করেন, যারা মানসিকভাবে অসুস্থ, কেবল তাদেরই কাউন্সেলিং প্রয়োজন। কিন্তু এটি একেবারেই ভুল ধারণা। আমি আমার কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে কেউ সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে, আর তখন একজন নিরপেক্ষ পরামর্শদাতা খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন। কাউন্সেলিং মানে কেবল সমস্যা নিয়ে কথা বলা নয়, বরং নিজের ভেতরের শক্তিগুলোকে খুঁজে বের করা এবং সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে সমাধানের পথ খুঁজে বের করা। যেমন, ক্যারিয়ার নিয়ে দ্বিধা, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, হতাশা, দুশ্চিন্তা – এই সব ক্ষেত্রে একজন ভালো পরামর্শদাতা আপনাকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। এটি আপনার মানসিক স্বাস্থ্যকে শক্তিশালী করে এবং আপনাকে জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করে তোলে। তাই এটিকে দুর্বলতা হিসেবে না দেখে, নিজের উন্নতির একটি সুযোগ হিসেবে দেখুন।
যোগ্য পরামর্শদাতা খুঁজে পাওয়ার উপায়
এখন প্রশ্ন হলো, একজন ভালো পরামর্শদাতা কিভাবে খুঁজে পাবেন? এই প্রশ্নটা আমার কাছে অনেকেই করেন। বাংলাদেশে এখন অনেক যোগ্য পরামর্শদাতা আছেন। আপনারা অনলাইনে সার্চ করে, বিভিন্ন ক্লিনিক বা মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে যোগাযোগ করে একজন ভালো পরামর্শদাতা খুঁজে পেতে পারেন। তবে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। প্রথমত, পরামর্শদাতার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা যাচাই করে নিন। দ্বিতীয়ত, আপনার সমস্যাটি কোন ক্ষেত্রে এবং সেই বিষয়ে পরামর্শদাতার বিশেষত্ব আছে কিনা, তা দেখুন। তৃতীয়ত, পরামর্শদাতার সাথে কথা বলে দেখুন, তার সাথে আপনার সহজ সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে কিনা। কারণ, একজন পরামর্শদাতার সাথে আপনার খোলামেলা আলোচনা করার জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা অপরিহার্য। আমার পরামর্শ হলো, প্রথম সেশনটি কেবল একজন নতুন পরামর্শদাতার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য ব্যবহার করুন, এবং দেখুন আপনি তার সাথে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন কিনা।
পরামর্শদাতার সাথে কেমন সম্পর্ক থাকা উচিত
পরামর্শদাতার সাথে আপনার সম্পর্কটা হবে একদম খোলামেলা এবং সততার। এখানে কোনো লুকোচুরি চলবে না। আপনার যা মনে হচ্ছে, যেভাবে মনে হচ্ছে, সবকিছু খুলে বলুন। মনে রাখবেন, পরামর্শদাতা আপনাকে বিচার করার জন্য নয়, বরং আপনাকে সাহায্য করার জন্য আছেন। আমি দেখেছি, অনেকে প্রথম দিকে নিজেদের সব কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন, কিন্তু ধীরে ধীরে যখন তারা বুঝতে পারেন যে, এখানে তারা নিরাপদ, তখন নিজেরাই মন খুলে কথা বলেন। পরামর্শদাতা আপনাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করবেন, যা আপনার নিজের ভেতরের চিন্তাভাবনাগুলোকে স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে। তিনি আপনাকে কোনো সরাসরি সমাধান দেবেন না, বরং সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে সাহায্য করবেন। এই পুরো প্রক্রিয়াটি খুবই ব্যক্তিগত এবং সম্মানজনক। আপনার গোপনীয়তা নিশ্চিত করা হবে, তাই নির্ভয়ে নিজের কথাগুলো বলুন।
পারিবারিক বন্ধন শক্তিশালী করার উপায়: ছোট ছোট পদক্ষেপ, বড় পরিবর্তন

একসাথে সময় কাটানোর গুরুত্ব
পরিবারের বন্ধন মানে শুধু একই ছাদের নিচে বাস করা নয়, এর মানে হলো একে অপরের প্রতি গভীর ভালোবাসা, বোঝাপড়া আর সহযোগিতা। এই বন্ধনটা শক্তিশালী করার জন্য একসাথে সময় কাটানোটা ভীষণ জরুরি। আজকালকার ব্যস্ত জীবনে আমরা সবাই নিজের কাজ নিয়ে এতটাই মগ্ন থাকি যে, পরিবারের সদস্যদের সাথে কোয়ালিটি টাইম কাটানোটা যেন ভুলেই গেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো বন্ধুরা, এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তোলে। আমি আমার নিজের পরিবারে সবসময় চেষ্টা করি, রাতে একসাথে বসে রাতের খাবার খাওয়ার। তখন আমরা সারাদিনের গল্প করি, কে কি করলাম, কি শিখলাম – সব কিছু ভাগাভাগি করি। এইটুকু সময়ই কিন্তু আমাদের মধ্যে বোঝাপড়ার জায়গাটা আরও বাড়িয়ে দেয়। এমনকি ছুটির দিনে একসাথে সিনেমা দেখা বা রান্না করাও দারুণ এক পারিবারিক bonding activity হতে পারে।
পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়া বৃদ্ধি
একটা পরিবারে পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর বোঝাপড়া না থাকলে সেই সম্পর্কটা টেকসই হয় না। বাবা-মায়েদের যেমন সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে, তেমনি সন্তানদেরও বাবা-মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে। আর এই শ্রদ্ধাটা শুরু হয় একে অপরের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে। যখন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন যদি পরিবারের সবার মতামতকে শোনা হয়, তাহলে সবাই নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আমি অনেক পরিবারে দেখেছি, বাবা-মা জোর করে নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন, ফলে শিশুরা নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে ভয় পায়। এতে করে দূরত্ব বাড়ে। বরং পরিবারের ছোট-বড় সব বিষয়ে আলোচনা করে একটি সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোটা খুব জরুরি। এটি শুধু বোঝাপড়াই বাড়ায় না, বরং একে অপরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসও তৈরি করে।
সক্রিয় পারিবারিক কার্যক্রমের সুফল
পারিবারিক বন্ধন শক্তিশালী করার জন্য কিছু সক্রিয় পারিবারিক কার্যক্রম খুব উপকারী। যেমন – একসাথে কোনো দাতব্য কাজে অংশ নেওয়া, কোনো খেলাধুলা করা, পিকনিকে যাওয়া বা নতুন কোনো জায়গায় ঘুরতে যাওয়া। এই কাজগুলো কেবল বিনোদনই দেয় না, বরং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একতা তৈরি করে। আমি দেখেছি, যখন কোনো পরিবার একসাথে কোনো চ্যালেঞ্জিং কাজ করে, তখন তারা একে অপরের সাথে আরও বেশি সংযুক্ত বোধ করে। এই ধরনের অভিজ্ঞতাগুলো সারা জীবন মনে থাকে এবং পারিবারিক স্মৃতি হিসেবে রয়ে যায়। এগুলো শিশুদের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং অন্যের প্রতি সহমর্মিতা তৈরি করতেও সাহায্য করে। তাই, শুধু বাসায় বসে টিভি না দেখে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাইরে বের হন, নতুন কিছু করুন – দেখবন আপনার পরিবারের বন্ধন কতটা মজবুত হয়ে ওঠে।
| সমস্যা (Problem) | প্রস্তাবিত সমাধান/সহায়তা (Suggested Solution/Support) |
|---|---|
| মানসিক চাপ ও হতাশা (Mental Stress & Depression) | পারিবারিক সমর্থন, স্কুল কাউন্সিলিং, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খোলামেলা আলোচনা, শখ ও সৃজনশীল কাজে অংশগ্রহণ। |
| ডিজিটাল আসক্তি (Digital Addiction) | স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ, বিকল্প সৃজনশীল কার্যকলাপে অংশগ্রহণ, অনলাইন সুরক্ষা শিক্ষা, বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধান। |
| পারিবারিক কলহ (Family Conflict) | অভিভাবকদের সাথে খোলামেলা যোগাযোগ, প্রয়োজনে পারিবারিক কাউন্সিলিং, একে অপরের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া। |
| কিশোর অপরাধের প্রবণতা (Tendency for Juvenile Delinquency) | সঠিক নির্দেশনা, ইতিবাচক সঙ্গ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, মাদকবিরোধী সচেতনতা। |
| ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা (Uncertainty about Future) | কেরিয়ার কাউন্সিলিং, দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞদের সাথে পরামর্শ, লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা। |
আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়া
শিক্ষাব্যবস্থায় যুগোপযোগী পরিবর্তন
বন্ধুরা, আমাদের এই তরুণ প্রজন্মই কিন্তু আগামীর বাংলাদেশ। তাই ওদের জন্য একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। আর এর প্রথম ধাপটা শুরু হয় শিক্ষাব্যবস্থা থেকে। আমি দেখেছি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো অনেকটা মুখস্থনির্ভর, যা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে বাধা দেয়। অথচ এখন দরকার এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা, যা শিক্ষার্থীদের শুধু সিলেবাস শেষ করাবে না, বরং তাদেরকে বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত করবে। হাতে-কলমে শিক্ষা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, আর সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা – এই বিষয়গুলোকে সিলেবাসে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ফিনল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো কিভাবে শিক্ষাকে আনন্দময় করে তুলেছে, আমরা সেই মডেলগুলো থেকেও অনেক কিছু শিখতে পারি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সঠিক পরিবর্তন আনতে পারি, তাহলে আমাদের তরুণ প্রজন্ম শুধু ভালো ফল নয়, ভালো মানুষ হিসেবেও গড়ে উঠবে।
বৃত্তি ও কর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ
শুধুই ভালো ফলাফলের পেছনে না ছুটে, তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নেও জোর দেওয়া প্রয়োজন। আজকাল চাকরির বাজারে কেবল ডিগ্রি থাকলেই হয় না, বিভিন্ন ব্যবহারিক দক্ষতাও খুব জরুরি। তাই, তরুণদের জন্য কারিগরি শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানো উচিত। যেমন, ফ্রিল্যান্সিং, গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, কোডিং – এই ধরনের কোর্সগুলো তাদের আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করবে। অনেক সময় আমি দেখি, উচ্চশিক্ষিত হয়েও তরুণরা বেকার বসে আছে, কারণ তাদের হাতে কোনো ব্যবহারিক দক্ষতা নেই। সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এই বিষয়ে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। আমি মনে করি, স্কুল জীবন থেকেই যদি শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন কাজের প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায়, তাহলে তারা ভবিষ্যতে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ক্যারিয়ার বেছে নিতে পারবে এবং দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে।
সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ
সবশেষে বলতে চাই, শিক্ষাগত যোগ্যতা বা দক্ষতার পাশাপাশি তরুণদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানোও অত্যন্ত জরুরি। একজন শিক্ষিত মানুষ যদি মানবিক না হয়, সমাজের প্রতি তার কোনো দায়বদ্ধতা না থাকে, তাহলে সেই শিক্ষা মূল্যহীন। ছোটবেলা থেকেই ওদেরকে শেখাতে হবে কিভাবে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হয়, কিভাবে সমাজের জন্য ভালো কাজ করতে হয়। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে অংশ নিতে উৎসাহিত করতে হবে, যা তাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরি করবে। আমার বিশ্বাস, এই তরুণ প্রজন্মই পারবে একটা সুন্দর, উন্নত ও মানবিক বাংলাদেশ গড়তে। ওদের দিকে একটু যত্ন আর মনোযোগ দিলেই দেখবে, ওরা কতটা ঝলমলে হয়ে ওঠে!
শেষ কথা
বন্ধুরা, আজকের এই আলোচনা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে ছিল। আমরা দেখেছি, ওদের জীবনে কত ধরনের চ্যালেঞ্জ আসে – মানসিক চাপ থেকে শুরু করে ডিজিটাল আসক্তি, পারিবারিক বোঝাপড়া, এমনকি ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তাও। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, ওদের পাশে আমরা যদি থাকি, তাহলে এই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অনেক সহজ হয়ে যায়। ওদের কথা শোনা, ওদেরকে বিশ্বাস করা আর সঠিক পথে চলতে সাহায্য করা – এইটুকুই হয়তো ওদের জীবন বদলে দিতে পারে।
আমি নিজে এই যাত্রায় তোমাদের পাশে থাকতে পেরে খুব আনন্দিত। মনে রাখবে, প্রতিটি তরুণ মনই এক একটা সম্ভাবনা, এক একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বীজ। তাদের সঠিক পরিচর্যা করতে পারলে একদিন তারাই আমাদের সমাজকে আলোকিত করবে। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে এই তরুণ প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর এবং নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তুলি।
কিছু দরকারি টিপস
এখানে কিছু দরকারি টিপস দেওয়া হলো যা আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য সহায়ক হতে পারে:
1. সন্তানের সাথে খোলামেলা আলোচনা করার জন্য প্রতিদিন অন্তত কিছুটা সময় বের করুন। তাদের দিন কেমন গেল, কী নতুন শিখল বা অনুভব করল, তা নিয়ে গল্প করুন।
2. ডিজিটাল স্ক্রিন ব্যবহারের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিন। ঘুমানোর আগে অন্তত এক ঘণ্টা মোবাইল বা ল্যাপটপ থেকে দূরে থাকুন এবং পরিবারের সবাইকে এই অভ্যাস গড়ে তুলতে উৎসাহিত করুন।
3. মানসিক চাপ বা হতাশা অনুভব করলে নির্দ্বিধায় একজন অভিজ্ঞ পরামর্শদাতার সাহায্য নিন। মনে রাখবেন, এটি কোনো দুর্বলতা নয়, বরং নিজের যত্নের একটি অংশ।
4. আউটডোর খেলাধুলা, বাগান করা, পছন্দের বই পড়া বা কোনো সৃজনশীল শখের পেছনে সময় দিন। এটি মনকে সতেজ রাখে এবং ডিজিটাল আসক্তি থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে।
5. পারিবারিক বন্ধন শক্তিশালী করার জন্য একসাথে খাবার খান, ছুটির দিনে ঘুরতে যান বা কোনো সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নিন। এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলো সম্পর্কের গভীরতা বাড়ায়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির সারসংক্ষেপ
আজকের আলোচনা থেকে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখলাম। প্রথমত, তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যকে কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনাটা খুব জরুরি। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে সচেতন ব্যবহার এবং বিকল্প বিনোদন খুঁজে বের করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তৃতীয়ত, পারিবারিক বন্ধন এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে এবং একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে মূল ভূমিকা পালন করে। সবশেষে, শিক্ষাব্যবস্থায় যুগোপযোগী পরিবর্তন এবং দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। এই পদক্ষেপগুলোই তাদের জন্য এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরি করবে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ) 📖
প্র: আজকালকার তরুণ-তরুণীরা কী কী নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে এবং কেন তাদের মন খারাপ বা হতাশ লাগছে?
উ: আমার নিজের অভিজ্ঞতা আর চারপাশে যা দেখি, তাতে মনে হয় আজকালকার ছেলেমেয়েরা যেন একটা অদৃশ্য যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পড়াশোনার চাপ এখন আকাশছোঁয়া, ভালো ফল না করলে যেন জীবনটাই বৃথা!
তার উপর আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চাপ। ওখানে সবাই যেন ‘পারফেক্ট’ একটা জীবন দেখাচ্ছে, যা দেখে আমাদের তরুণদের মনে হীনমন্যতা আর হতাশা কাজ করে। ‘আমি কেন ওদের মতো নই?’ – এই চিন্তাটা খুব কষ্ট দেয়।ভবিষ্যৎ নিয়েও ওদের অনিশ্চয়তা কম নয়। চাকরি পাওয়া, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, একটা সুন্দর জীবন গড়া – সবকিছুই যেন অনেক কঠিন মনে হয়। আবার বাবা-মায়েরা এখন অনেক ব্যস্ত, ফলে অনেক সময় সন্তানেরা পরিবার থেকে পর্যাপ্ত মনোযোগ পায় না। এর ফলে তারা স্মার্টফোন বা অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। এতে পরিবারের সাথে বন্ধনটা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, যেটা মন খারাপ বা হতাশায় ডোবার একটা বড় কারণ।এছাড়াও বন্ধুরা অনেক সময় খারাপ পথে টেনে নিয়ে যায়। মাদকের সহজলভ্যতা আর সমাজে কিছু দুষ্টচক্রের প্রভাব ওদের বিপথে ঠেলে দিচ্ছে। শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের এই বয়সে হরমোনের ওঠানামা মেজাজকে খুব প্রভাবিত করে, যা অনেক সময় ছেলেমেয়েদের অস্থির করে তোলে। সব মিলিয়ে ওরা ভীষণ চাপের মধ্যে থাকে, আর তাই ছোট ছোট বিষয়ও ওদের জন্য অনেক বড় মনে হয়, ফলে হতাশা আর উদ্বেগে ভুগতে থাকে।
প্র: বাবা-মা বা অভিভাবকরা কীভাবে এই কঠিন সময়ে তাদের সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করতে পারেন এবং তাদের বিপথে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেন?
উ: আমার মনে হয়, বাবা-মা বা অভিভাবকরাই পারেন এই সময়ে তরুণদের সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে উঠতে। প্রথমত, সন্তানের সাথে খোলামেলা কথা বলার একটা পরিবেশ তৈরি করাটা খুব জরুরি। ওরা যেন নির্ভয়ে সব কথা বলতে পারে, সেই আস্থাটা দিতে হবে। প্রতিদিন অন্তত কিছুক্ষণ হলেও ওদের সাথে গল্প করুন, ওদের দিনের খবর নিন। হয়তো এটা খুব কঠিন মনে হতে পারে যখন আমরা সবাই ব্যস্ত থাকি, কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই ওদের জীবনে অনেক বড় প্রভাব ফেলে।ওদের বন্ধু-বান্ধব কারা, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে – এগুলোর খোঁজ রাখা দরকার, তবে যেন তারা নিজেদের স্বাধীনতা হারাচ্ছে বলে মনে না করে। ডিজিটাল দুনিয়ায় ওরা কতটা সময় কাটাচ্ছে, কী দেখছে, সেদিকেও একটু নজর রাখা ভালো। তবে সেটা গোয়েন্দাগিরি না হয়ে, যেন বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়।সবচেয়ে বড় কথা হলো, ওদেরকে সুস্থ জীবনযাপনে উৎসাহিত করতে হবে – যেমন ভালো খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম আর নিয়মিত খেলাধুলা। এতে ওদের শরীর ও মন দুটোই সতেজ থাকবে। আর যদি দেখেন সন্তান ভীষণ মনমরা হয়ে আছে বা অস্বাভাবিক আচরণ করছে, তাহলে দেরি না করে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না। মনে রাখবেন, সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে অনেক বড় সমস্যা এড়ানো যায়।
প্র: যখন একজন তরুণ-তরুণী মানসিকভাবে খুব চাপে থাকে, একা বোধ করে, বা হতাশায় ডুবে যায়, তখন তারা নিজেরা কী করতে পারে অথবা কাদের সাহায্য নিতে পারে?
উ: যখন মন খারাপ বা হতাশ লাগে, একা মনে হয়, তখন মনে হতে পারে যে পৃথিবীটা বুঝি শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে, এই অনুভূতিগুলো ক্ষণস্থায়ী, আর এগুলো থেকে বেরিয়ে আসার অনেক পথ আছে। প্রথমে নিজের পছন্দের কোনো কাজ করুন – গান শোনা, বই পড়া, ছবি আঁকা বা বাগান করা। ছোট ছোট আনন্দগুলো মনকে চাঙ্গা করে তোলে।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, চুপ করে না থাকা। নিজের মনের কথা বিশ্বস্ত কারো সাথে শেয়ার করুন – সেটা হতে পারে বাবা-মা, ভাই-বোন, একজন ভালো বন্ধু বা স্কুলের কোনো শিক্ষক। বিশ্বাস করুন, মনের কথা হালকা করলে মনটাও অনেক হালকা লাগে। আমি নিজে দেখেছি, অনেক সময় শুধু কথা বললেই সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে যায়।এছাড়াও, শরীরচর্চা বা খেলাধুলা মন ভালো করার দারুণ একটা উপায়। নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীরে এমন কিছু হরমোন তৈরি হয় যা মনকে খুশি রাখে। ঘুমানোর সময় আর খাওয়ার রুটিন ঠিক রাখাটাও খুব দরকার।আর যদি মনে হয় এই হতাশা কাটছেই না, তখন পেশাদার সাহায্য নিতে একদমই লজ্জা পাবেন না। আমাদের আশেপাশে অনেক মনোবিজ্ঞানী বা কাউন্সেলর আছেন যারা চমৎকারভাবে সাহায্য করতে পারেন। স্কুল বা কলেজের কাউন্সেলর, এলাকার মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র – যেকোনো জায়গায় যোগাযোগ করতে পারেন। মনে রাখবেন, সাহায্য চাওয়া মানে দুর্বলতা নয়, বরং এটা আপনার সাহসের পরিচয়।






